শাহিনুর ইসলাম,লালমনিরহাট প্রতিনিধি: ঋতু বদলের হাওয়া লেগেছে প্রকৃতিতে। শিশিরসিক্ত হতে শুরু করেছে প্রকৃতি। মৃদু হিম হিম সকালবেলায় এই লালমনিরহাটের যা দেখা যাচ্ছে তাতে জোর দিয়েই বলা যায়, শরৎ বিদায় নিয়ে যে হেমন্ত এসেছে তা সবচেয়ে আগে বুঝতে পেয়েছেন এই শহর বা গ্রামের ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতারা।
রোদ পড়ে এলেই দিব্যি ব্যস্ত এলাকার ফুটপাত দিয়ে বসে যাচ্ছে ভাপা, চিতই, তেলের পিঠার আঞ্জাম। অফিস ফেরত লোক, বৈকালিক আড্ডার তরুণ, সন্ধ্যার অবসরে বেড়াতে বের হওয়া দম্পতিসহ অনেকেই ঘুরেফিরে এসে দাঁড়াচ্ছেন এসব পিঠার পসরার সামনে। সর্ষে বা কাঁচামরিচ সহযোগে ধনেপাতা বাটার সঙ্গে গরম গরম চিতই, গুড়-নারকেল মেশানো ভাপ ওঠা ভাপাপিঠা কেবল স্বাদে বৈচিত্র্য আনছে না, মনে করিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টি-বাদলের দিন শেষ। এলো আবার পিঠাপুলির মৌসুম।
প্রকৃতপক্ষে পিঠার মৌসুম হিসেবে খ্যাত শীতকাল। হেমন্তের বরং খানিকটা দুর্নাম আছে শুরুর দিকের অভাব-অনটনের জন্য। ‘মরা কার্তিক’, ‘আকালের কার্তিক’ এমন। হেমন্তের শেষাংশ অবশ্য সমৃদ্ধির। আবহমানকাল থেকেই অগ্রহায়ণ মানেই কৃষকের মুখে অনাবিল হাসি। ধানকাটা-মাড়াই নিয়ে পরিতৃপ্তির ব্যস্ততা। নবান্নর আয়োজন।ওদিকে শীতও তখন একটু একুট করে জাঁকিয়ে বসতে থাকে। পিঠা-পায়েসের আয়োজন, মেয়ে-জামাইকে নাইওর আনা, অতিথি আপ্যায়নসহ সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পুরো শীত মৌসুমটিই আনন্দঘন ও উৎসবমুখর হয়ে ওঠে জনজীবনে।
বর্ষার রেশ কেটে শীতের প্রভাব সক্রিয় করে তোলার মাঝখানে যে দুটি ঋতু শরৎ আর হেমন্ত, তাদের স্বাতন্ত্র্য শহরে ঠিক ধরা যায় না। শরৎকে যেমন মনে হয় বর্ষারই প্রলম্বিত অংশ, তেমনি হেমন্তও শীতের পূর্বরাগ।খেয়ালের শুরুতে যেমন আলাপ। কৃত্রিমতা যেখানে নিসর্গকে পুরোপুরি গ্রাস করেনি, সেখানেই হেমন্তের বৈশিষ্ট্যের স্বতঃপ্রকাশ। তার রূপও হৃদয় বিগলিত করার মতো দৃষ্টিনন্দন নয়। বরং একটু রুক্ষ, মরা মরা ভাব। মনটা কেমন যেন এক অজানা, অস্পষ্ট বেদনার আভাসে ভার হয়ে আসে। সম্ভবত সে কারণেই বাংলায় হেমন্ত নিয়ে উচ্ছ্বাস করার কবি জীবনানন্দ দাশ ছাড়া প্রায় দুর্লভ।
এত বড় নিসর্গ অনুরাগী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও হেমন্ত প্রসঙ্গে বেশ সংযত, অন্য ঋতুর তুলনায় তাঁর রচনায় হেমন্তের বরাদ্দ সামান্য। হেমন্তের কপালে তাই বন্দনার চেয়ে আকারে-প্রকারে নিন্দা-মন্দই জুটেছে বেশি।এক পরম বাস্তবতার সারসত্যের প্রকাশ আছে হেমন্তে। একদা বসন্তে যে নবীন পাতা ঝলমল করে উঠেছিল শাখায় শাখায়, মলিন বিবর্ণ হয়ে আসছে তারা। ফসলের মাঠে রিক্ততা। কৃষক কেটে নেবেন সোনালি ধান। মাঠে মাঠে এখন পড়ে থাকবে শুকনো খড়, বিচালি। বিকেল বেলায় সেই শূন্য মাঠের ওপর শুকনো ধুলো, কুয়াশা আর ধোঁয়া মিশে এক রহস্যের পর্দা যেন নেমে আসবে অন্তরীক্ষ থেকে। হঠাৎ হঠাৎ বয়ে যাবে গায়ে কাঁটা দেওয়া শীতল বাতাস। মনে করিয়ে দেবে উষ্ণতার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে,শীত আসছে ।
যেমন যৌবনের শেষে আসে জরা। এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। সেই নিয়মে হেমন্ত এসেছে কুয়াশার আঁচল উড়িয়ে, তারপর আসবে শীত, বসন্ত। জীবন ভরে উঠবে নবনব আনন্দ-বেদনার আখ্যানে।
Comments
comments