Download Free BIGtheme.net
Home / মতামত / অনলাইন জীবন

অনলাইন জীবন

একটা দৃশ্য কল্পনা করা যাক। আপনি একজন বাবা কিংবা মা, আপনার ছেলেমেয়েরা বড় হয়নি, তারা স্কুল-কলেজে পড়ে। একদিন আপনি বাসায় এসেছেন, এসে দেখলেন আপনার ছেলে বা মেয়েটি টেবিলে পা তুলে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা সিগারেট টানছে। আপনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী করছিস বাবা (কিংবা মা)?”

আপনার ছেলে কিংবা মেয়ে হাসি হাসি মুখে বলল, “সিগারেট খাচ্ছি আম্মু (কিংবা আব্বু)?”

তারপর টেবিল থেকে পা নামিয়ে বলল, “খাওয়ার পর একটা সিগারেটে টান না দিলে ভালোই লাগে না।”

কথা শেষ করে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে তার নাক দিয়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করল।

আপনি বললেন,” ঠিক আছে বাবা (কিংবা মা) সিগারেটটা শেষ করে হোমওয়ার্কগুলো করে ফেল।”

কথা শেষ করে আপনি ভেতরে গেলেন, মনে মনে ভাবলেন: “আমার ছেলেটি (বা মেয়েটি) কত লক্ষ্মী। বাইরে কোনো ঝুট-ঝামেলার মাঝে যায় না। ঘরের মাঝে থাকে, মাঝে মাঝে সিগারেট খায়!”

আমি জানি, আপনারা যারা স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়ের বাবা তারা আমার এই কাল্পনিক দৃশ্যটির বর্ণনা শুনে যথেষ্ঠ বিরক্ত হচ্ছেন। বলছেন, একজন বাবা কিংবা মা কখনও তার ছেলে বা মেয়ের এরকম একটা আচারণকে কখনও এত সহজভাবে নিতে পারে না।

অবশ্যই নিতে পারে না এবং কখনও নেয় না।

সিগারেট হচ্ছে নেশা। এরকম আরও অনেক নেশা আছে আমরা দৈনন্দিন জীবনে সেগুলো দেখে অভ্যস্ত নই। তাই কাল্পনিক দৃশ্যটিতে অন্য নেশাগুলোর কথা না বলে সিগারেটের উদাহরণটি দেওয়া হয়েছে।

আমাদের সন্তান কোনো একটা নেশায় আসক্ত হয়েছে জানতে পারলে আমরা সেটা মেনে নিতে পারব না। আমরা দুশ্চিন্তিত হব, বিচলিত হব এবং সন্তানকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্যে পাগল হয়ে যাব। যদি এই বিষয়টা সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের সন্তানদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে বসে থাকতে দিই?

যে বিষয়টি এতদিন একটা সন্দেহ বা আশংকা ছিল এখন সেই বিষয়টি গবেষণা জার্নালে বের হতে শুরু করেছে। কোকেন আসক্ত একজন মাদকাসক্ত মানুষকে যদি মাদক খেতে দেওয়া না হয় তাহলে তার মস্তিষ্কে যে কেমিকেলগুলো বের হয়ে তাকে অস্থির করে তোলে, ফেসবুকে আসক্ত একজন মানুষকে যদি ফেসবুক করতে দেওয়া না হয় তাহলে তার মস্তিষ্কে সেই একই ঘটনা ঘটে। বিষয়টি ছেলেমানুষী বিনোদন নয়, বিষয়টি মাদকে আসক্তির মতো গুরুতর একটি ঘটনা।

একসময় পত্রপত্রিকায়, রেডিও-টেলিভিশনে সিগারেটের বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। এখন বিজ্ঞাপন দিতে দেওয়া হয় না, বরং সিগারেটের প্যাকেটে লেখা থাকে: “ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর।” শুধু তাই নয় ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করার জন্যে ধূমপান করার পর ফুসফুসের কী অবস্থা হয় কিংবা ক্যানসারের বিকট ক্ষত দেখতে কী রকম তার ছবি সিগারেটের প্যাকেটে দিয়ে দেওয়া হয়।

আমার ধারণা আজ থেকে চার-পাঁচ বছর পর সারা পৃথিবীতেই কমবয়সী ছেলেমেয়েদের ফেসবুক জাতীয় অনলাইন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে নিরুৎসাহিত করার জন্যে আইন কানুন করা হবে, প্রচারণা করা হবে। ফেসবুকে লগ ইন করার সাথে সাথে প্রথমেই এটাকে আসক্ত হয়ে গেলে কী কী ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে যেতে পারে, সেটা নিয়ে সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হবে। তাই কাল্পনিক দৃশ্যটিতে অন্য নেশার কথা না বলে লেখালেখি করে সবাইকে এটি নিয়ে সতর্ক করে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

কারো কারো কাছে নিশ্চয়ই মনে হতে পারে যে, আমার পুরো বক্তব্যটা বুঝি একধরনের বাড়াবাড়ি। বিষয়টি মোটেও এমন কিছু গুরুতর নয়। কিন্তু আমি মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি– বিষয়টা যথেষ্ট গুরুতর। মানুষের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে সেটা যথেষ্ট রহস্যময়। একজন ছেলে বা মেয়ে যখন বড় হচ্ছে সেই সময়টাতে সে কিভাবে তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করেছে তার উপর অনেকখানি নির্ভর করে তার মস্তিষ্কের গঠনটি কেমন হবে। তাই একজন বড় মানুষের ফেসবুক আসক্তি দেখে আমি যতটুকু বিচলত হই তার থেকে অনেক বেশি বিচলিত হই যদি সেটি হয় কমবয়সী একটি ছেলে বা মেয়ের আসক্তি।

২.
আমরা আসলে একটা ক্রান্তিকালের মাঝে বাস করছি। পুরো পৃথিবীটা আসলে একটা খুব বড় ধরনের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখনও জানি না পরিবর্তনটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে থামবে। বিষয়টা অনেকটা তেজস্ক্রিয়তার মতো। বিজ্ঞানী মাদাম কুরি যখন তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে গবেষণা করেছেন তখন তিনি এই বিচিত্র রহস্যময় বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াটার ভয়াবহতার দিকটুকু জানতেন না। ল্যাবরটরিতে তিনি দিনের পর দিন তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করেছেন এবং নিজের অজান্তে অদৃশ্য তেজস্ক্রিয়তার রশ্মি তাঁর শরীরকে বিষাক্ত করে তুলেছে, তিনি শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছেন সেই তেজস্ক্রিয় রশ্মির কারণে।

আমার বর্তমান ইন্টারনেট কিংবা ফেসবুক আসক্তি দেখে এই তেজস্ক্রিয়তার কথা মনে হয়। আমরা যখন এর সুযোগ-সুবিধা, বৈচিত্র্য এবং বিনোদনে সম্মোহিত হচ্ছি ঠিক তখন অদৃশ্য তেজস্ক্রিয় রশ্মির মতো কিছু একটা আমাদের ভেতরে গুরুতর একটা পরিবর্তন করে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও আমরা অনেক বেশি মনোযোগী ছাত্রছাত্রী পেতাম। এখন তাদের মনোযোগ কেন কমে যাচ্ছে? ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ফেসবুকের কি এখানে প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে?

আজ থেকে দশ বছর পরে হয়তো আমরা জানতে পারব শৈশব-কৈশোরে মাঠে-ঘাটে ছোটাছুটি করে খেলাধূলা না করে দিনের পর দিন রাতের পর রাত ছোট একটা স্ক্রিনের সামনে বসে থাকার কারণে আমাদের কী ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছে। তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে, আমাদের কিছু করার থাকবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে একটুখানি কমনসেন্স হয়তো আমাদের অনেক বড় বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে।

আগেই বলেছি আমরা একটা খুব বড় পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। একটা সময় ছিল যখন সাধারণ মানুষ তার বক্তব্যটা অন্যদের শোনাতে পারত না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের কথা ভেবে বলেছিলেন:

“এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা…”

তিনি বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন, কারণ সত্যি সত্যি একেবারে আক্ষরিক অর্থে মূঢ় ম্লান মূকদের মুখে ভাষা দেওয়া হয়েছে, তাদের বক্তব্যটি অন্যরা শুনবে কি না– সেটি ভিন্ন কথা। কিন্তু একেবারে সাধারণ একজন মানুষ তার কথাটি কিন্তু ইন্টারনেটের কোনো একটা সার্ভিস ব্যবহার করে সবার উদ্দেশ্যে বলে দিতে পারে। কেউ এর শক্তিটুকু অস্বীকার করতে পারবে না।

যদি ফেসবুক কিংবা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক না থাকত তাহলে সম্ভবত গণজাগরণ মঞ্চের মতো বিশাল একটা আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হত না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সপক্ষে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর মানুষকে একত্র করা সম্ভব হত না। কাজেই যারা একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এই প্রযুক্তিকে নিজের কাজে ব্যবহার করছেন আমি তাদের এতটুকু খাটো করে দেখছি না। কিন্তু এই প্রযুক্তি যাদের ব্যবহার করছে আমার দুশ্চিন্তা তাদের নিয়ে!

সবাই হয়তো জানে না, যারা এই প্রযুক্তি গড়ে তুলছে তাদের জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ছলে-বলে-কৌশলে কোনো একজনকে তাদের ওয়েব সাইটে কিংবা পোর্টালে নিয়ে আসা এবং যত বেশি সম্ভব তাদের সেখানে আটকে রাখা। যারা আমার কথা বিশ্বাস করেন না তাদের বলব– ‘বিবিসি’র মতো কোনো সম্ভ্রান্ত একটা নিউজ মিডিয়ার সাইটে যেতে। আশেপাশে তাকান আপনি কী দেখবেন? সারা পৃথিবীতে কত গুরুতর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু সেখানে তাদের চিহ্ন নেই। একেবারে না দিলেই নয় সে রকম একটি-দুটি ঘটনার পাশাপাশি শুধু রগরগে কিংবা চুটল খবর। তার যে কোনো একটাতে ক্লিক করে দেখেন আপনাকে নিজে থেকে তারা একটার পর একটা ভিডিও দেখাতে শুরু করবে, আপনার মনের জোর যদি যথেষ্ট বেশি না থাকে কিছু বোঝার আগেই আপনি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ভিডিও দেখে দেখে ঘণ্টাখানেক সময় নষ্ট করে ফেলবেন।

আপনি যদি এভাবে সময় নষ্ট করার কারণে অপরাধবোধে ভুলে থাকেন তাহলে জেনে রাখুন আপনি একা নন, সারা পৃথিবীতে আপনার মতো কোটি কোটি মানুষ এভাবে সময় নষ্ট করছে। আপনি কোন ধরনের ওয়েবসাইটে গিয়েছেন সেটি বিশ্লেষণ করে আপনাকে লোড দেখিয়ে দেখিয়ে সেই ধরনের জায়গায় ঠেলে দেবে! শুধুমাত্র তথ্যপ্রযুক্তির সেবা গ্রহণ করেছেন বলে এই সাইবার জগৎ কিন্তু আপনার সম্পর্কে সব কিছু জানে।

আর মাত্র কিছুদিন, তারপর আপনি অবাক হয়ে আবিষ্কার করবেন, আপনি যদি একটা সুপারমার্কেটে যান তাহলে সেখানকার কোনো একটা স্ক্রিনে আপনাকে নাম ধরে সম্মোধন করে বলবে, “অমুক সাহেব, শরীরটা কেমন? পেটের ব্যথাটা কি বেড়েছে? আমরা খুব সস্তায় অ্যান্ডোসকপি করছি, চলে আসুন তিন তলায়!”

মজার কথা হলো যারা এগুলো দাড়া করছেন তারা কিন্তু বিষয়টাকে খুব আধুনিক একটা প্রযুক্তি জেনেই করছেন। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন বলে যে কিছু থাকছে না সে বিষয়ে কিন্তু কারো এতটুকু মাথাব্যাথা নেই।

তবে বিষয়টা যে একেবারে কারো নজরে পড়ছে না, তা নয়। আমি সেদিন খবরে দেখছি বড় একটা শহরে একটা রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে যেখানে ওয়াই-ফাই নেই। কেউ স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ নিয়ে যেতে পারবে না। যারা সেখানে ডিনার করতে যাবে তারা সময়টা কাটাবে সামনাসামনি বসে গল্পগুজব করে। কিছুক্ষণের জন্যে হলেও ওয়াই-ফাই নেই, ইন্টারনেট নেই, কারো সাথে চ্যাট করার চাপ নেই– এই বিষয়টা যে একটা রেস্টুরেন্টের আকর্ষণীয় দিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, সেটি কিন্তু অনেক বড় ব্যাপার।

আমরা এখন সবাই দেখি ইন্টারনেটের কোনো পত্রপত্রিকায় লেখা বের হওয়ার পর তার নিচে মন্তব্য লেখার একটা সুযোগ থাকে। (আমার লেখা বের হওয়ার পরও নিশ্চয়ই কেউ না কেউ সেখানে মন্তব্য লিখে ফেলেন। আমি যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বলছি– আমি কখনও এই মন্তব্যগুলো পড়ি না। আমার ধারণা, আমি যদি সেগুলো পড়ি তাহলে হয়তো নিজের অজান্তেই ভালো ভালো মন্তব্য পাওয়ার লোভে পাঠকদের খুশি করার জন্যে লিখতে শুরু করব।)

যখন লেখার পেছনে তাৎক্ষণিক মন্তব্য লেখার একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল তখন অনেকের ভেতরেই একটা ধারণা জন্মেছিল যে, এটি নিশ্চয়ই খুব চমৎকার একটা ব্যাপার। কিন্তু পৃথিবীর অনেক পত্রপত্রিকা কিন্তু টের পেয়েছে যে, বিষয়টা আসলে এমন কিছু আহামরি ব্যাপার নয়। কারণ দেখা গেছে যারা মন্তব্য লেখেন তারা অনেক চিন্তাভাবনা করে লেখাটার বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করেন, তা নয়। বেশিরভাগই যা ইচ্ছা হয় তা-ই লিখে বসে থাকেন। অপছন্দের মানুষ হলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতেও সংকোচ হয় না। এই বিষয়টা সত্যিকার সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে; আমরা যত অপছন্দই হোক আমরা সামনাসামনি কাউকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করি না। কিন্তু সাইবার জগতে চোখের আড়ালে থেকে এটি করতে কোনো বাধা নেই।

মানুষজন শুধু যে একটুখানি সময় নিয়ে মন্তব্য লিখতে চায় না তা-ই নয়, তাদের যেন মন্তব্য লিখতে না হয় শুধু একটা ক্লিক করে ‘লাইক’ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে ফেলা যায়– সেই ব্যবস্থাও করে রাখা হয়েছে। ‘লাইক’ দেওয়া নিয়ে কিছুদিন আগে আমি একটা সত্যি ঘটনা শুনেছি। একটি বাচ্চা মেয়ে ফেসবুকে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে কিছু একটা পোস্ট করে দিয়ে অপেক্ষা করে আছে যে সেখানে কেউ ‘লাইক’ দেবে। যখন দেখতে পেল কেউ তাকে খেয়াল করে ‘লাইক’ দিচ্ছে না, তখন সে নিজেই আরও একটা অ্যাকাউন্ট খুলে সেই অ্যাকাউন্ট থেকে নিজেকে ‘লাইক’ দিতে থাকল!

বিষয়টা একটা কৌতুকের বিষয় কিন্তু তারপরও এটা শুনে আমি কেন জানি একটু আহত অনুভব করেছি। আমার মনে হয়েছে কেন আমার দেশের একটি ছোট মেয়ে জীবনের প্রতি এরকম একটা দীনহীন মনোভাব নিয়ে কাঙালের মতো বড় হবে? কে ঠিক করে দিয়েছে জীবনকে অর্থপূর্ণ হতে হলে ফেসবুকে ‘লাইক’ পেতে হবে?

৩.
কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক ইন্টারনেট আসক্তি কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে যদি বলা হয়, ফেসবুক আসক্তি একটি সত্যিকারের দুর্ভাবনার বিষয়। যাদের আসক্তি আছে কিন্তু স্বীকার করতে চান না তাদের জন্যে খুব সহজ একটা এক্সপেরিমেন্ট আছে। তারা নিজেরাই বের করতে পারবেন সত্যি সত্যি তারা আসক্ত কি না। তাদের দুই সুপ্তাহের জন্যে ফেসবুক থেকে দূরে থাকতে হবে। যদি সেটা করতে পারেন, আমার মনে হয়, তারা বলতে পারবেন যে তারা শুধুমাত্র ফেসবুক ব্যবহার করেন, তাদের কোনো আসক্তি নেই!

আমি অনেকের কথা জানি যারা ফেসবকু কিংবা সোশাল নেটওয়ার্ক থেকে পৃথিবীর খবর পাওয়ার চেষ্টা করেন। শুধু তা-ই নয়, সেখানে যে তথ্যই পাওয়া যায় তারা সেটাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে বসে থাকেন! মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকেরা রেডিও-টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা বিশ্বাস করেন না, তারা তাদের আজগুবি বিচিত্র এবং বেশিরভাগ সময়েই আপত্তিকর খবরগুলো অনলাইনের নানা তথ্য থেকে পান। আমরা জানি, অনলাইনে আমাদের দেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা খুবই সোচ্চার, তারা নানাভাবে সেখানে প্রচারণা চালিয়ে যায়।

আকাশের চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখা গিয়েছে– এ রকম নির্জলা মিথ্যা প্রচারণা করতেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না। এই প্রচারণার বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দেওয়ার মতো তরুণদেরও কোনো অভাব নেই। সত্যি কথা বলতে কি অনলাইন যুদ্ধ ক্ষেত্রটিতে এতই উত্তেজনা থাকে যে, ‘অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট’ নামে একটি নূতন শব্দই তৈরি হয়ে গেছে। কাজেই মোটামুটি গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, আমাদের ধরা যায়, ছোঁয়া যায় এই বাস্তব জীবনের পাশাপাশি যে ভার্চুয়াল অনলাইন জীবনের জন্ম হয়েছে– সেটি টিকে থাকার জন্যেই এসেছে। তবে এটি ভবিষ্যতে কোনদিকে যাবে, আমরা জানি না।

আমি তাই সবাইকে মনে করিয়ে দিই, অনলাইন জীবনের পাশাপাশি যে রক্তমাংসের বাস্তব জীবনটি আছে সেটি যেন আমরা ভুলে না যাই।

লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

Comments

comments