মুহম্মদ পাঠান সোহাগ : ভোর ৬টা। কয়েক বন্ধু মিলে ঢাকা মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রা করি। উদ্দেশ্য ময়মনসিংহ শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনা আর দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা। কোনো রকম বাধা-বিপত্তি ছাড়াই আমরা পৌনে ৯টায় ময়মনসিংহ শহরের মাসকান্দা বাস টার্মিনালে প্রবেশ করলাম। শহরের গাঙ্গিনার পাড়ে সকালের নাস্তা শেষে আবারো ছুটলাম শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা পুরান ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে হারিয়ে গেলাম অনেক দর্শনার্থীর মতো আমরাও। নদের বুকে বিশাল জলরাশির ওপর দিয়ে ছুটে চলার আনন্দ নিরিবিলি পরিবেশে উপভোগ করলাম।
নদের তীরে সারি সারি নৌকা। নৌকায় করে এপার-ওপার যাতায়াত করছে লোকজন। আমরাও চড়ে বসলাম একটিতে। অনেকেই ব্যস্ত হয়ে গেল নৌকায় বসে সেলফি তুলতে। মাঝ নদে কথা হয় নৌকার মাঝি মো. নয়নের সঙ্গে। তিনি জানান, দর্শনার্থীর চাপ থাকে সরকারি ছুটির দিনে আর বিভিন্ন উৎসবের সময়। তখন তার ভালো আয় হয়। তার কাছ থেকে জানা গেল, নৌকাভেদে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকা দিয়ে এখানে ঘুরতে পারেন দর্শনার্থীরা।
নদীতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে তীরে উঠতেই চোখে পড়ল একরাশ কাশফুল। নদের একপাশে শহর আর একপাশে গ্রামীণ জনপদ। প্রতিদিন বহু মানুষের পদচারণায় মুখরিত থাকে এলাকাগুলো। শহরের ব্যস্ত জীবন ছেড়ে কিছুটা সময় প্রকৃতির সান্নিধ্যে কাটাতেই এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। যেদিকে তাকাই সেদিকেই সবুজের সমারোহ, সবুজের ওপর দিগন্ত বিস্তৃত সাদা কাশফুল ও নীলের ছোঁয়া। নদের তীরে প্রচুর কাশবন, বৃক্ষরাজি আর সবুজ ঘাসে ছাওয়া মাঠ।
নদের তীরেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালার অবস্থান। দুপুরের খাবারের আগেই আমরা ঢুকে পড়লাম সেখানে। ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল মোট ৭০টি চিত্রকর্ম নিয়ে যাত্রা শুরু করে এই সংগ্রহশালাটি। বর্তমানে বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা ৬১টি মৌলিক শিল্পকর্ম, ১টি শিল্পকর্মের ডিজিটাল অনুকৃতি, শিল্পাচার্যের ৮০টি নিদর্শন ও ৫৩টি আলোকচিত্র সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্ম বৃহত্তর ময়মনসিংহে ১৯১৪ সালে। এই ব্রহ্মপুত্রের তীরে বসেই তিনি এঁকেছেন প্রচুর ছবি। আমরা সংগ্রহশালাটি অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম।
দুপুরের খাবারের পর আবারো শুরু হলো সেই ঘোরাঘুরি। অল্প সময়ে শহরের কাছাকাছি ঐতিহাসিক সব নিদর্শন আর স্থাপনা দেখলাম। দুপুর গড়াতেই ছুটিতে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরতে শুরু করে মানুষ, শহরবাসীসহ ভ্রমণপিপাসুদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে নদের তীর। জেলা শহরসহ আশপাশের উপজেলা ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিনোদনপ্রেমী মানুষ ভিড় করেন শশী লজ, ময়মনসিংহ জাদুঘর, আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্ক ও সংগ্রহশালায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কামরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, বাড়ি বেড়াতে এসে ময়মনসিংহে অবস্থান করি। এ শহরে থাকলে মনের টানে বিকেলে নদের পাড়ে আসতেই হয়। নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ উদ্যানে। তিনি আরো বলেন, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন গ্যালারি, পাঠাগার, শিশুপার্ক, মিনি চিড়িয়াখানা, বিশ্রামাগারসহ নানা আয়োজন নিয়ে নতুন রূপ নিয়েছে উদ্যানটি। সৌন্দর্যও বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। এ কারণে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে।
সারাদিন ঘোরাঘুরির পর একরাশ প্রশান্তি নিয়ে আবারো পা বাড়ালাম রাজধানীর পথে। পুরো ময়মনসিংহে দেখার মতো রয়েছে অনেক কিছু। কেউ যদি বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তাগাছার জমিদার বাড়ি, গৌরীপুরের বিবি সখিনার মাজার, ভালুকার কুমির প্রজনন কেন্দ্র, ফুলবাড়িয়ার অর্কিড বাগান, আলাদিনস্ পার্ক দেখতে চান তাহলে রাত্রি যাপন করতে হবে এ শহরে। তবে সে ব্যাপারে চিন্তার কিছু নেই। ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে পঞ্চাশের অধিক সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হোটেল, রেস্ট হাউস, গেস্ট হাউস, ডাক বাংলো রয়েছে। আপনার সুবিধা মতো যেকোনো একটিতে উঠতে পারেন। তবে খাবার ও থাকার মানভেদে খরচের পরিমাণ ভিন্ন হবে।
যেভাবে যাবেন : রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে অনেক বাস যায় ময়মনসিংহে। প্রতিজন খরচ পড়বে সর্বোচ্চ ২২০ টাকা। তবে লোকাল বাসে না যাওয়াই ভালো। তাছাড়া কমলাপুর থেকে ট্রেনে করে যাওয়া যাবে। প্রতিজন ট্রেন ভেদে সর্বোচ্চ ১১০ টাকা লাগবে। বাস টার্মিনাল বা স্টেশন থেকে রিকশা অথবা অটো নিয়ে সরাসরি শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যানে যেতে পারেন। খরচ পড়বে ২০ থেকে ৫০ টাকা।
Comments
comments