Download Free BIGtheme.net
Home / জেলার খবর / অক্ষরজ্ঞানের সন্ধানে ইউএসসি বয়স্ক বিদ্যালয়

অক্ষরজ্ঞানের সন্ধানে ইউএসসি বয়স্ক বিদ্যালয়

গোলাম মওলা সিরাজ, কুড়িগ্রাম: রাত ১১টা। সব দিকে নীরবতা। দিনের ব্যস্ত সড়কও অনেকটা ফাঁকা। মাঝে-মধ্যে দু’একটি গাড়ীর হর্ণ। এর মাঝে কুড়িগ্রাম ভুরুঙ্গামারী সড়কের নাগেশ্বরী পৌর এলাকার হ্যালিপ্যাড মোড়ে অ আ ক ও খ-এর অনবরত পড়ার শব্দ কানে আসে। ভিতরে গিয়ে দেখা গেল পড়ার শব্দে মুখরিত তিনটি কক্ষ। কক্ষের সব ছাত্রের হাতে প্রথম শ্রেণির আমার বই। কারো কারো হাতে। বর্ণমালা শিক্ষার বই। কিন্তু সব ছাত্রই বয়স্ক। সবার বয়স ১৪ থেকে ৫০ বছরের। এ বয়সে এসে তারা পড়ছেন স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জন বর্ণ। জীবনের এ বয়সে এসে শিশুদের পড়া পড়লেও তাদের চোখে-মুখে খুজে পাওয়া যায় জয়ের আভা। যেন সাফল্য তাদের খুব কাছাকাছি। শিশুদের মত শিশু শ্রেণির বই-এ সবার চোখ। কাঁচা হাতে লিখছে অনেকে অ, আ, ক, খ, ১, ২ ও ধ, ন, প এবং ফ। জানা গেল এটি প্রতি রাতের চিত্র এখানকার। জানা গেল এটি স্থানীয় রতন রায়ের উদ্যোগে কয়েক তরুণের প্রয়াস একটি বয়স্ক বিদ্যালয়। এটি ১৪ থেকে ৫ বছর বয়সী নিরক্ষর বয়স্কদের অক্ষর জ্ঞান দানের প্রচেষ্টা। বর্তমানে ৪৪ জন বয়স্ক শিক্ষার্থী অক্ষরজ্ঞান নিচ্ছে।

সার্বজনিন বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র (ইউএসসি বয়স্ক বিদ্যালয়) ২০১৪ সালের শুরুতে রতন চন্দ্র রায় এজন ছাত্র নিয়ে তার কামারপাড়ার বাড়িতে শুরু করেন পড়ানো। তার কিছুদিনের মধ্যে ছাত্র সংখ্যা দাঁড়ায় চারে। পরে জায়গার সংকট দেখা দিলে রাতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে আজ এ দোকান কাল অন্য দোকানের বারান্দায় পাঠদান করাতো। পরে স্থাণীয় আরো কয়েক তরুণ সহায়তার হাত বাড়ায়। সবার সমন্বয়ে বর্তমানে হ্যালিপ্যাড মোড়ে তিনকক্ষের ভাড়া বাসায় পাঠদান চলছে। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৪ জন। রাত সাড়ে আটটা থেকে ১২টা পর্যন্ত তিনটি পৃথক ব্যাচে তাদের পাঠদান করা হয়। ১৪ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত নিরক্ষর সবার জন্য উন্মুক্ত ইউএসসির দরজা। কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা চাই এমন করে সারাদেশের শিক্ষিত যুবকরা এগিয়ে আসুক। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশকে পরিপূর্ণ করতে আগে নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ুক। তবে দ্রুত ডিজিটাল দেশ গড়া সম্ভব। সবার জন্য উন্মুক্ত এ শিক্ষা কার্যক্রম।

ইউএসসি বয়স্ক বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র পেশায় নরসুন্দর আলমগীর ইসলাম (২৬) বলেন, আমার সব বন্ধু পড়ালেখা জানতো। এক সঙ্গে চলতে গেলে সবাই পেপার দেখে পড়তো। আমি মোবাইল কিনেছি। কিন্তু নাম্বার পড়তে লিখতে পারতাম না। এখন নিজের নাম ঠিকানা লিখতে পারি। হিসেব করতে পারি। পত্রিকা পড়তে পারছি ইউএসসি স্কুলে পড়ার কারণে।

আর এক ছাত্র আব্দুল মজিদ। বয়স ৫০। সারাদিন শ্রমিকের কাজ করেন একটি বেকারীতে। রাত ৯টায় পড়তে আসেন। এ বয়সে এসে পড়ছেন অ আ ক খ। তার সাথে আসেন ওই প্রতিষ্ঠানের আরো তিন শ্রমিক দুলাল মিয়া, মাসুদ রানা ও ফরিদুল ইসলাম। সবার বাড়ি কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রাপুর। তারা কর্মস্থল নাগেশ্বরীতে থাকেন। এ সুবাদে পড়ালেখাটাও করছেন পারছেন। এদের মত ৪৪জন পড়ছেন রতন রায় চন্দ্রের ইউএসসি বয়স্ক বিদ্যালয়ে। এরা সবাই শ্রমিক। দিনে কাজ করেন। রাতে আসে পড়তে। অটো চালক বিশ্বনাথ চন্দ্র বর্মণ ও শাহজাহান পড়ছেন এখানে। এরা বলেন অটো নিয়ে ভাড়ায় গেলে অনেকে দোকানের নাম বলতো। সাইনবোর্ড পড়তে না জানায় ভুল হতো। এখন আর ভুল হয়না। কেউ হিসাবে কম দিতেও পারেনা। আগে যা হতো। হোটেল শ্রমিক মোবারক ও রামকান্ত বলেন আগে নিজের নাম লিখতে পারতাম না। পত্রিকা পড়তে না পারায় অন্যকে দিয়ে পড়িয়ে নিজে শুনতান। এখন নিজে পড়তে পারি। ট্রলি চালক একরামুল হকের ইচ্ছে এখান থেকে শিখে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাডেমিক শিক্ষা নেয়ার। বলেন, চাকুরী নয়; ইচ্ছে আছে মেট্রিক পাশ করবো।

রতন রায়ের উদ্যোগ ভাল লাগলে এগিয়ে আসনে এলাকার মাইদুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, মোন্নাফ আলীসহ এলাকার কয়েকজন তরুন। নাগেশ্বরী উপজেলাকে নিরক্ষর মুক্ত করতে তাদের এ যাত্রা। শিক্ষায় কোন বয়স নাই; এটি বুঝিয়ে সবাইকে স্কুল করাতে কাজ করছেন তারা। শিক্ষার্থীদের খাতা, কলম, বই দিচ্ছে বিনা টাকায়।

ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে বিবিএ’র ছাত্র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রতন রায় জানান, আমরা উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে ইউএসসির শাখা খুলে সেখানে গ্রামের লোকজনদের নিরক্ষরমুক্ত করার পরিকল্পনা করেছি। কিন্তু এতে অনেক টাকার প্রয়োজন। এজন্য পারছিনা। তবে থামছিনা আমরা। উপজেলাকে নিরক্ষরমুক্ত করতে আমাদের এ যাত্রা সেদিন থামবে যেদিন কেউই অক্ষর জ্ঞান শূণ্য থাকবেনা।

ঘরের জামানতসহ আববাসপত্র কিনতে প্রায় ৬০হাজার টাকা লেগেছে। পরিচালনা কমিটির সদস্যরা টাকা হার করে দিয়ে চালাচ্ছে। প্রতি মাসে ঘরভাড়া দুই হাজার, বিদ্যুৎ বিল, আপ্যায়নসহ প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ দিতে হয়। দিনে দিনে খরচ বাড়ছে। এতে শঙ্কিত তারা। রতন রায় বলেন, আমরা হাফিয়ে উঠছি। কতদিন চারাতো পারবো। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাইদুল ইসলাম বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। সেখান থেকে আর্থিক সহায়তা পাঠাচ্ছেন।

এবার ১ জানুয়ারী বই উৎসবের সাথে একই দিনে আয়োজনকে শিক্ষার্থীদের মাঝে খাতা, কলম ও বই বিতরণ করেছেন তারা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। বিদ্যালয়টি নিরক্ষরদের স¦াক্ষর জ্ঞান দেয়ার পাশাপাশি ভুমিকা রাখছে মাদকাশক্ত ও বাল্যবিবাহ রোধে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন করে সমাজকে নিরক্ষর, মাদক ও বাল্যবিবাহ রোধক কার্য করে যাচ্ছে।

নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হায়াত মো. রহমতুল্লাহ বলেন, রতন রায়ের বয়স্ক বিদ্যালয়ের উদ্যোগটা আমাকে অভিভূত করেছে। তার কয়েকটি কর্মসূচীতে গিয়ে মনে হয়েছে তাদের মত করে সারাদেশে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এতে নিরক্ষর কেউ থাকবেনা। সুযোগ পেলে তাদের জন্য উপজেলা প্রশাসন বরাদ্দ দেবে।

Comments

comments