বাংলাদেশ অনলাইন ডেস্কঃ এক সময় গ্রাম-গঞ্জের পালাগান, ভাওয়াইয়া, যাত্রাপালা কিংবা বাউল গানের আসরে ছন্দ দিতো দেশীয় বাদ্য। একতারা, দোতরা, সারিন্দা, খমক বাদ্য এখন শুধু বইয়েই। কিন্তু কালের আবর্তনে বিলুপ্তির পথে এ লোকজ সংস্কৃতির অনুষঙ্গগুলো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আকাশ সংস্কৃতি আর পৃষ্টপোষকতার অভাবে লোকবাদ্যের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে জায়গা নিচ্ছে পাশ্চাত্যের যন্ত্র। এতে নতুন প্রজন্ম যেমন নিজেদের লোকজ সংস্কৃতি চর্চা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তেমনি বাংলার প্রাণের গান হারাচ্ছে নিজস্বতা।
দোতারা- বাঙালিয়ানার স্বাদ পাওয়া যায় এ বাদ্যে। প্রতিটি গানের দলেই দোতরা বাদক থাকেন, অনেক সময় মূল শিল্পীই বাজান এটি।
প্রচলিত আছে, প্রাচীন বাংলায় প্রথম দোতারার উৎপত্তি। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বিহারে লোকজ গানে এর প্রচলন ব্যাপক।
দোতারায় দু’টি তার (স্ট্রিং) মুখ্য। তবে উত্তরবঙ্গের রাজবংশী শিল্পীদের কোথাও ২-৪-৫টি তার থাকার কথা শোনা যায়। গানে তাল দেয় দু’তার-ই।
ভাওয়াইয়া শিল্পী পঞ্চানন রায় বলেন, মূলত ১৫০০-১৬০০ শতাব্দী থেকে বাউলদের মাধ্যমেই এর প্রচলন। ভাওয়াইয়া ছাড়াও বাউল গানেও তাল দিয়ে মানুষকে আদিকাল থেকেই মোহিত করে এসেছে।
নিম বা শক্ত গাছের কাঠ দিয়ে দোতারার মূল বডি তৈরি, যা দেখতে গোলাকৃতির। আর ‘ফিংগারবোর্ড’ বানানো হয় ‘স্টিল’ কিংবা ব্র্যাশ (পিতল) দিয়ে। মেইন বডির কিছু অংশে থাকে চামড়া। মাথাটি ‘ময়ূর’ এর মাথার আকৃতিতে বানানো হয়, করা হয় কারুকার্যও।
বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের শিল্পী পঞ্চানন বলেন, এখন আধুনিক বাদ্যের অনুপ্রবেশে দোতরার ব্যবহার কমে যাচ্ছে। যন্ত্রীরাও পেশা বদল করে চলেছেন জীবিকার প্রয়োজনে।
তবে গানের নিজস্বতা ও ঐতিহ্যটি নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় পৃষ্টপোষকতা দরকার বলে মত তার।
লোকজ গানের অন্যতম প্রধান বাদ্য সারিন্দা, কালের বির্বতনে এর জায়গাটি নিয়ে নিচ্ছে বেহালা। তবে কুড়িগ্রামের রাজবংশী সম্প্রদায়ের কিছু শিল্পী এখনও যন্ত্র ব্যবহার করেন।
তাদেরই একজন শিরীষ চন্দ্র বর্মা, ষাটোর্ধ্ব এ বৃদ্ধ এখনও নতুন প্রজন্মের কাছে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, প্রাণ কান্দে মৈশাল বন্ধুরে’ সুর তুলে ধরেন। উলিপুরে বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমির নিয়মিত এক বাদক ও প্রশিক্ষক।
এ বিষয়ে একাডেমির পরিচালক ভূপতি ভুষণ বর্মা বলেন, যন্ত্রটি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রাম অঞ্চলে কোথাও আগের মতো ব্যবহার নেই, একেবারেই হাতে গোনা।
‘আমরা এখানে (একাডেমি) ভাওয়াইয়া গান শেখাতে যন্ত্রটি ব্যবহার করি। বাচ্চাদের শেখাই, যাতে ভাওয়াইয়ার ঐতিহ্য রক্ষা করতে পারে।’
সারিন্দার মাথার ওপর ময়ূর বা অন্যান্য পশুপাখির মাথার নকশা করা থাকে। সেখানে তিনটি কাঠের বয়লা (বা কান) থাকে। দেড় ফুট লম্বা কাঠ দিয়ে তৈরি যন্ত্রটির থাকে চামড়ার তিনটি তার, যা বয়লা থেকে সওয়ারির ওপর দিয়ে সারিন্দার শেষ প্রান্তে আংটা দিয়ে আটকানো থাকে, বয়লা বা কান ঘুরিয়ে প্রয়োজন মতো তারগুলোর সুর ধ্বনি নিয়ন্ত্রণ বা টিউন করা হয়।
যন্ত্রটি বাজাতে ঘোড়ার লেজের তৈরি ছড়ি ব্যবহৃত হয়, যা দেখতে ধনুকের মতো। ‘পটরি’র ওপর বাঁ হাতের অনামিকা আর মধ্যমা দিয়ে তারে চাপ দিয়ে সেই সঙ্গে ডান হাতে ছড় টেনে সারিন্দা বাজানোর নিয়ম বলেই জানালেন শিরীষ বর্মা।
প্রাচীন এমনকি মধ্যযুগের কলা ও কাব্য সাহিত্যেও এর ব্যবহার ছিলো বলে জানা যায়।
‘বাংলাদেশ ছাড়াও আফগানিস্তান, পাঞ্জাব, বিহার, রাজস্থান, আসাম ও ওড়িষাসহ পশ্চিমবঙ্গের অনেক জেলায় যন্ত্রটির ব্যবহার রয়েছে,’ উল্লেখ করেন বিখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী ভূপতি।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র পরামর্শে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সারিন্দার মতো দেখতে আরেকটি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করেছিলেন যার নাম ‘চন্দ্রসারঙ’। যাতে চামড়ার বদলে পিতলের তার ব্যবহার করা হয়। তবে বর্তমানে এসবের সংরক্ষণ নেই বললেই চলে।
তবে ভাওয়াইয়াসহ উত্তর জনপদের গানে এখনও তাল দেয় করতাল বা জুড়ি, খমক ও ঢোলক। এসব বাদ্যযন্ত্র আর আগের মতো তৈরি হয় না, বসে না গান-বাজনার আসরও।
তাই শিল্পীরাও পেশা পরিবর্তন করে নতুনভাবে জীবিকা উপার্জনে ব্যস্ত।
‘রেডিও টিভিতে গান করতে গেলেও বাদক পাওয়া যায় না। সেখানে লোকজ বাদ্যও অনেক সময় থাকে না। গান গাইলেও নিজস্বতা থাকে না,’ আক্ষেপ করে বলছিলেন ভাওয়াইয়া শিল্পী ভবতরণ বর্মা।
সূ্ত্র : বাংলা নিউজ
Comments
comments