বাংলাদেশ অনলাইন ডেস্কঃ গল্পটা একজন শ্রমজীবি, অটোচালক সরোয়ারের । বরগুনা থেকে ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমিয়েছিলো রাজধানীতে । চোখে-মুখে স্বপ্ন ছিলো আলোকিত ভবিষ্যতের । বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোঁটানোর । ভাই-বোনদেরকে শিক্ষিত করে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার । উজ্জ্বল ভবিষ্যত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিলো । অথচ গত পরশু তার সলিল সমাধি হল, তবে তা কোন তুচ্ছ মৃত্যু নয় ।
দু’জনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই পরার্থে আত্মদান করলেন । জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও যিনি অন্যের উপকারে মৃত্যুর দুয়ারে ঝাঁপাতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই সাধারণ কোন মানুষ নন । তিনি মহৎ প্রাণের অধিকারী । সভ্যতা-আধুনিকতার দোহাই দিয়ে যে সময়টাতে অটোচালক-রিকশাওয়ালাদের মানুষজ্ঞান করা হয়না ঠিক সেই সময়টাতে সরোয়ারের আত্মদান প্রমাণ করেছে, আমরা ভুলের নরক রাজ্যে ছিলাম ।
জীবন জীবনের জন্য, মানুষ মানুষের জন্য-চিরন্তর এ উক্তির আবারও সফল প্রয়োগ দেখালো তারুণ্যের প্রতীক আমাদের গর্ব সারোয়ার । আত্মবাদিতায় যখন সব কিছু নির্ভরতা পাচ্ছিল, স্বার্থবাদিত যখন মানুষকে নৃশংস হতে বাধ্য করছিল, তখন সরোয়ারের ত্যাগ আমাদের ঘুমন্ত বিবেককে জাগানোর জন্য আবার ধাক্কা দিলো সপাটে । এবারো কি আমরা মানবতার জয়গান গেয়ে জেগে উঠতে পারবো না ?
বঙ্গবাহাদুরকে নিয়ে যখন সবাই রঙ্গে ব্যস্ত তখন সরোয়ার নিজের জীবন মায়াকে তুচ্ছ করে রক্ষা করে গেলেন দু’দুটো জীবন । হয়ত বঙ্গবাহাদুরের মৃত্যুর সংবাদাধিক্যে আমরা সরোয়ারের মৃত্যুর খবরটাই জানতে পারিনি । একজনের সরোয়ারের গল্পটা এখানেই শেষ নয় । এই সরোয়ার সর্বদা বন্ধুবাৎসল্য ছিলেন । এক বন্ধুর মা মারা যাওয়ার পর তাকে কুমিল্লা পৌঁছে দেয়ার মত যখন অন্য কেউ ছিলো না, তখন এই বন্ধুর মায়ের লাশ বহন করে সরোয়ার কুমিল্লা গিয়েছিলো ।
রাজধানীর এক অসহায় বৃদ্ধ মা যখন টাকার অভাব চিকিৎসা করাতে পারছিলো না তখন সরোয়ার অটো চালিয়ে জমানো টাকা দিয়ে সেই মায়ের চিকিৎসা করিয়েছিলো । বৃদ্ধা-অসুস্থ মা সরোয়ারের আপন ছিলো না কিন্তু মানবতার টানে সরোয়ারের স্বপ্নই ছিলো মানুষের উপকার করার । অথচ আমরা সরোয়ারের সহকর্মী-ধর্মী হয়ে মানুষের কল্যানে কতটুকু করছি ? কতটুকু আত্মত্যাগের উপমা সৃষ্টি করতে পারছি ? মানুষ হিসেবে প্রকৃত মানুষের যে দায়িত্ব তার কতভাগ আমাদের দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে ? সরোয়ারের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা অর্জন করা আবশ্যক ।
যে তারূন্যের শক্তি হবে সরোয়ারের ত্যাগের অনুরূপ সেই তারুণ্য আজ মানুষের জীবন রক্ষা করতে নয় বরং ধ্বংস করতে লেলিহান দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে । অবনতির চরম সীমায় তারুণ্য আজ সর্বতভাবে পদাঘাত । স্বার্থবাদ কর্মের নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে । আমরা ভুলে গেছি মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব । মানুষের খোলসে আজ আমাদের মধ্যে অমানুষের বাস । সরোয়ারের আত্মত্যাগ দেখে যদি মানবতা হিতৈষী হতে না পারি তবে সেটা আমাদের দূর্ভাগ্য । আমরা একেকজন সরোয়ার মত হতে চাই, চাওয়া উচিত । যিনি জীবনের বিনিময়ে অন্য জীবন রক্ষা পায় তিনি মহৎ জীবনের অধিকারী ।
মানবতার কল্যান, মানুষের মঙ্গলে আমরা যেনো আত্মনিবেদিত হতে পারি । মানুষের জয়গান, মানবতার প্রণামে তারুণ্য রব তুলুক সর্বব্যাপী । সরোয়ারদের আত্মা দেহ থেকে আলাদা হতে পারে কিন্তু মানুষের মনে সরোয়ারেরা বেঁচে থাকে চিরকাল । শ্রদ্ধা-দু’আর সাথে যুগান্তর জুড়ে সরোয়ারদের ত্যাগের মহিমা বর্ণিত হয় । মানুষ ওদের ভালোবাসে, সম্মান করে । শুরুতেই বলেছিলাম, সরোয়ারের গল্পের কথা । তবে এ গল্পটার শুরু আছে, শেষ নাই ।
রাজু আহমেদ । কলামিষ্ট
Comments
comments